
নারী, শান্তি এবং আমার কিছু কথা
আমি একজন মানুষ। কিন্তু এ আত্মোপলব্ধি আমার আমার শৈশব থেকে আসেনি নিজের মাঝে। হ্যা,এই উপলব্ধি এসেছে তখন যখন আমি কৈশোরে পদার্পণ করি। কেননা, শৈশবে পরিবার আর আশেপাশের পরিবেশ থেকে জেনেছিলাম আমার পরিচয়, আমি মেয়েমানুষ, আমি বোন, আমি বান্ধবী, আমাকে বুঝতে হয়েছিলো আমি আমার দেশের পিছিয়ে পড়া অর্ধেক জনগোষ্ঠীর একজন। কিন্তু আমার মাঝে তিলতিল করে গড়ে উঠা মানবিক মূল্যবোধ,নৈতিকতা আর আমার অর্জিত জ্ঞান আমাকে উপলব্ধি করিয়েছে যে আমি একজন মানুষ। আমি বিশ্বাস করি নারীরা মনে ও চিন্তা-চেতনায় শান্তিপ্রিয়। তবে এটাও ঠিক শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে আমি মনে করি সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় নারীদের আসতে হবে। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। ছেলে হোক, মেয়ে হোক নারীর প্রতি শ্রদ্ধার ক্ষেত্রে পরিবারের শিক্ষাটি সবচেয়ে জরুরি। নারীদের যত বেশি ক্ষমতায়ন হচ্ছে, তত বেশি তাদের শত্রু বাড়ছে। আমার মনে হয়, চারদিকে নারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। একটি চলন্ত বাসে নারী ধর্ষিত হচ্ছে। কর্মস্থলে নারীদের কাজের পরিবেশসহ নানা প্রতিকূলতা আছে।
নারী পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। নারীও এ সমাজের সর্বক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারে। একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রথমে পরিবার, পরে কর্মস্থল, সমাজ ও রাষ্ট্রের সহায়ক ভূমিকা প্রয়োজন। সেজন্য নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে। যার শুরু হবে পরিবার থেকেই। নারীকে যদি শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখতে হয় তাহলে আগে নারীকে তার জায়গায় দাঁড়াতে হবে। সেই জায়গাটিতে দাঁড়াতে হলে নারীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। কিন্তু আজকে নারীর সমাজে টিকে থাকাটা কঠিন হয়ে পড়েছে। পারিবারিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন কারণে নারীর জন্য এই প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। নারীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য যেসব আইন রয়েছে, সেগুলোকে সমন্বয় করতে পারলে আমরা ভালো একটা ফল পেতে পারি। বাংলাদেশে নারীরা অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছে। পরিবর্তনের জন্য সময় দিতে হবে। নারীর প্রতি নির্যাতন দমনে আমরা যদি নিজেরা পরিবর্তন হতে না পারি, তাহলে সমাজ বা রাষ্ট্র সেটাকে পাল্টাতে পারবে না। আমরা যেন যেকোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে পারি, সেজন্য আমাদের নিজেদের তৈরি করতে হবে। রাষ্ট্র-সমাজ এসে পরিবর্তন করে দেবে না। তারা এই পরিবর্তনের জন্য ভূমিকা পালন করতে পারে, কিন্তু মূল কাজটি নিজেকেই করতে হবে।নারী একার চেষ্টায় শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারবে না, তাকে সংগঠিতভাবে ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমাদের সংবিধানে নারীর শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন মৌলিক চাহিদা ও সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে। তবে, শিক্ষা ব্যবস্থায় অনেক ক্ষেত্রে কিছু বৈষম্য আমরা কাটিয়ে উঠেছি। ছেলে ও মেয়েদের সমান অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে গেছি। কিন্তু মূল সমস্যা থেকে গেছে কারিকুলামে। ইদানীংকালে দেখা যাচ্ছে, শান্তি ও সম্প্রীতি রক্ষার জন্য যেসব উপকরণ, যেমন মূল্যবোধ, নৈতিকতাবোধ, তা অনেক ক্ষেত্রেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর চাপে যেন আমরা নতি স্বীকার না করি। নারী-পুরুষের ভূমিকাকে সামনে রেখে কারিকুলামে যেন সাম্যাবস্থা থাকে। নারী-পুরুষের ন্যায্যতা, সমতার ভিত্তিতে কারিকুলাম ঠিক করা উচিত।
শৈশব থেকে ছেলেমেয়েদের মাঝে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ,সুশিক্ষা এবং সঠিকভাবে নারী পুরুষের সমঅংশগ্রহণ ও সমঅধিকারের বিষয়টি তুলে ধরতে পারলে, বোঝাতে পারলে “শান্তিতে নারী,সম্প্রীতিতে নারী” কথাটি পারিবারিক,সামাজিক,প্রাতিষ্ঠানিক, রাজনৈতিক সহ প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থবহ হবে।
জাকিয়া সুলতানা
কার্যনির্বাহী সদস্য
উইমেন পিস ক্যাফে, জাককানইবি
নোট: উইম্যান পিস ক্যাফের নানা কার্যক্রমের সার্বিক সহযোগিতায় রয়েছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের, সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিস (সিপিজে)। ২০১৮ সালে ‘এমপাওয়ার্ড উইম্যান পিসফুল কমিউনিটি’ প্রকল্পের প্রথম ধাপে উইম্যান পিস ক্যাফে শান্তি পূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠায় নারীর ক্ষমতায়ন, উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগ, নারীদের করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন কমিউনিটি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়নরত নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ ও উদ্যোক্তা তৈরিতে একটি সৃষ্টিশীল প্লাটফর্ম হিসেবে সর্বপ্রথম দেশের আঞ্চলিক দুটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ( জাককানইবি ও বেরোবি ) তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। তারই ধারবাহিকতায় ইউএন উইমেনের অর্থায়নে তৃতীয় ধাপে ‘সিকিউরিং দ্যা পিস অফ অ্যান্ড অনলাইন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় সেন্টার ফর পিস এন্ড জাস্টিস (সিপিজে), ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের এই ফেইজে নারীদের, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এবং সমাজের তৃণমূল স্তরের নারীদের নানাবিধ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়ন মূলক কর্মকান্ডে ও কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সচেতনতামূলক কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করা এবং নতুন করে দেশে আরো দুইটি বিশ্ববিদ্যালয় (ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে) উইম্যান পিস ক্যাফে স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা তৃণমূল পর্যায়ে কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রমের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে কোভিড-১৯ এর ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং অফলাইন এবং অনলাইনে শান্তি, সৌহার্দ্য এবং নারীর সুরক্ষা নিশ্চিতে কাজ করবে এই প্রকল্পটি।